বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগে কোটার যুগ শেষ হলো। গতকাল মঙ্গলবার ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে দুই হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। গত ৪৮ বছর ধরে চলা কোটা পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে এটাই শেষ বিসিএসের ফলাফল।
২০১৮ সালে সাধারণ ছেলেমেয়েদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা প্রথা বিলুপ্ত করে। পিএসসি বলছে, এই বিলুপ্তির ফলে এখন থেকে পরবর্তী আর কোন বিসিএসে কোটা পদ্ধতি থাকছে না। এমনকী, কোটা পদ্ধতি বিলোপের মাসখানেক আগে ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হলেও ওই বিসিএসেও কোটা পদ্ধতি থাকছে না বলে জানিয়েছেন পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। এর ফলে সাধারণ ছেলেমেয়েদের চাকরির সুযোগ আরও বাড়বে বলে মনে করছে পিএসসি।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তিন বছর পর ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের জন্য গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় কর্মকমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেই ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল অনুমোদন দেওয়া হয়।
গতকাল প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, সাধারণ ক্যাডারে মোট ৬১৩ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রশাসনে ৩০৬ জন, পুলিশে ১০০ জন, পররাষ্ট্রে ২৫ জন, নিরীক্ষা ও হিসাবে ৪৫ জন, আনসারে ৩৮ জন, কর বিভাগে ৩৫ জন, ডাক বিভাগে ২৫ জন, তথ্যে ২৪ জন, পরিবার পরিকল্পনায় ১১ জন, রেলওয়েতে সাতজন ও খাদ্য ক্যাডারে পাঁচজনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি।
কারিগরী বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারে ২৪১ জন, বিসিএস (মৎস্য) ক্যাডারে ২০ জন, বিসিএস (পশুসম্পদ) ক্যাডারে ৮৫ জন, বিসিএস (বন) ক্যাডারে ২২ জন, বিসিএস (গণপূর্ত) ক্যাডারে ৯৭ জন, বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে ২৯১ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি কলেজ) ক্যাডারে ৭৬৮ জন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতি বিসিএসে মেধায় কতজন ও কোটায় কতজনকে নিয়োগ করা হয়, সেটা আলাদাভাবে প্রকাশ করা হলেও ৩৪তম বিসিএস থেকে সেটা করা হচ্ছে না। অবশ্য পিএসসি বলছে, ৫৫ শতাংশ কোটা এবং ৪৫ শতাংশ মেধা এই নিয়ম মেনে ৩৮তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সাধারণ ক্যাডারে কোটার সব প্রার্থী পাওয়া গেলেও কারিগরী ক্যাডারে কোটার প্রার্থী যেখানে পাওয়া যায়নি সেখানে সাধারণ প্রার্থী দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের ৫ মার্চ চাহিদা ৩৮তম বিসিএসের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য পাঠিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ২০ জুন এই নিয়োগের জন্য ৩৮তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি।
২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তিন লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ প্রার্থী আবেদন করেন। ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। তাতে উত্তীর্ণ হন ১৬ হাজার ২৮৬ জন। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়। এক বছর পর ২০১৯ সালের ১ জুলাই লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে সেখানে পাস করেন নয় হাজার ৮৬২ জন।
লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর গত বছরের ২৯ জুলাই থেকে ৩৮তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়। নয় হাজার প্রার্থীর ভাইভা নিতে সময় লাগে আট মাস। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি সেই মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়। এরপর থেকে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের যে অপেক্ষা শুরু হয়েছিল, তা গতকাল শেষ হয়।
এখন পরবর্তী ধাপে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ যাচাইয়ের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করবে। এরপরেই সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীরা চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন।
কোটা প্রথার সমাপ্তি: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সে সময় মেধাতালিকা ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে, ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করে সর্বশেষ ৫৫ শতাংশের কোটা করা হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা ছিল। পরে ১ শতাংশ কোটা প্রতিবন্ধীদের জন্যও নির্ধারণ করা হয়।
তবে বিভিন্ন বিসিএসের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়েও একদিকে চাকরি পাননি, আর অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। পিএসসির প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাওয়ায় ২৮ থেকে ৩৮ তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে অন্তত ছয় হাজার পদ খালি ছিল। এমনকী, শুধু কোটার প্রার্থীদের নিয়েগের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়া হলেও ওই বিসিএসেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৯৮টি সহ মোট এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। শুধু বিসিএস নয়, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য নিয়োগেও একই অবস্থা হয়।
এসব কারণে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে। এপ্রিলে সেই আন্দোলন দেশব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে। আস্তে আস্তে সেটি বাংলাদেশের প্রায় সবকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। এরপর পুলিশ কোটা সংস্কার আন্দোলন কর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে। তখন দেশবরেণ্য বিভিন্ন লেখক, শিক্ষক কোটা সংস্কার আন্দোলনকর্মীদের পাশে দাঁড়ান। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটা ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে সরকার।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (যেসব পদ আগে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি বলে পরিচিত ছিল) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই সরকার আরেকটি প্রজ্ঞাপনে জানায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (৯ম থেকে ১৩তম) নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো কোটা বহাল নেই। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কোটার বিষয়ে আগের জারি করা পরিপত্র স্পষ্ট করার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সরকারি চাকরিতে অষ্টম বা তার ওপরের পদেও সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হলেও ১৯০৩টি পদে নিয়োগের জন্য ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় বিশ হাজার প্রার্থী এখন ফলের অপেক্ষোয় আছে।
এই বিসিএসে কোটার পদ্ধতির বিষয়ে কী হবে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক গতকাল রাতে বলেন, ‘কোটা পদ্ধতি বিলোপের মাসখানেক আগে ৪০ তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হলেও আমরা বলেছিলাম কোটা বিষয়ে সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হবে। সরকার যেহেতু কোটা প্রথা বিলুপ্ত করেছে এখন থেকে পরবর্তী আর কোন বিসিএসে কোটা পদ্ধতি থাকছে না। ফলে ৪০তম বিসিএসেও কোটা থাকছে না। কাজেই ৩৮তম বিসিএসকেই বলা যায় যেখানে কোটার ‘সর্বশেষ প্রয়োগ হলো’।