বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর হাজারো স্বপ্ন নিয়ে বের হচ্ছেন অসংখ্য তরুণ-তরুণী। তাঁদের হাতে থাকে মূল্যবান একটি ডিগ্রি, চোখে থাকে ভালো একটি চাকরির স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের পথটি যেন এক বন্ধুর মরুভূমি। এক পাশে চাকরিপ্রত্যাশীদের দীর্ঘ সারি, অন্য পাশে নিয়োগদাতাদের হতাশ মুখ। ডিগ্রি ও চাকরির বাজারের মধ্যে এই বিশাল ফারাক তৈরি হচ্ছে কেন? এই সমস্যা কি শুধু সীমিত সুযোগের, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কিছু কারণ?

ডিগ্রি একাই যথেষ্ট নয়, দরকার দক্ষ হাতের জাদু

অনেক গ্র্যাজুয়েট মনে করেন, ভালো ফলাফলের একটি সার্টিফিকেটই চাকরির বাজারে তাঁদের প্রধান সম্পদ। কিন্তু নিয়োগদাতারা এখন শুধু মেধার মাপকাঠি খোঁজেন না, তাঁরা খুঁজছেন এমন মানুষ যারা বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে পারে। তাঁরা বলছেন, "আমরা শত শত সিভি পাই, কিন্তু সেখানে এমন কোনো দক্ষতা খুঁজে পাই না যা দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজে লাগানো যাবে।"

সফট স্কিল এবং হার্ড স্কিল — এই দুই ধরনের দক্ষতার অভাবই নতুন গ্র্যাজুয়েটদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। একাডেমিক সিলেবাসে আমরা যা শিখি, তা প্রায়শই বাস্তব জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়।

  • হার্ড স্কিল (Hard Skills): ডেটা অ্যানালাইসিস, ডিজিটাল মার্কেটিং, পাওয়ার বিআই (Power BI), এসইও (SEO), গ্রাফিক ডিজাইন, বা কোডিংয়ের মতো প্রযুক্তিগত দক্ষতা এখন প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই অপরিহার্য। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এসব দক্ষতা অর্জনে উদাসীন থাকেন।
  • সফট স্কিল (Soft Skills): যোগাযোগ, দলগত কাজ, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, নেতৃত্ব এবং সময় ব্যবস্থাপনার মতো দক্ষতাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থেকে অর্জিত হয়। নিয়োগদাতারা দেখেন, গ্র্যাজুয়েটরা এই জায়গাগুলোতে ভীষণ দুর্বল।

অভিজ্ঞতার শূন্যতা: ইন্টার্নশিপ একটি বিলাসীতা নয়, একটি প্রয়োজন

আমাদের দেশে ইন্টার্নশিপকে প্রায়শই ঐচ্ছিক বা অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই সুযোগটি কাজে লাগান না। অথচ একটি ইন্টার্নশিপ শুধুমাত্র বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা দেয় না, এটি একজন শিক্ষার্থীকে কর্পোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এটি শেখায় কীভাবে পেশাদার পরিবেশে আচরণ করতে হয়, কীভাবে সময়মতো কাজ জমা দিতে হয় এবং কীভাবে সহকর্মীদের সাথে কাজ করতে হয়।

অভিজ্ঞতার অভাবে গ্র্যাজুয়েটদের সিভি প্রায়শই ফাঁকা থাকে, যা নিয়োগদাতার কাছে তাঁদের আগ্রহের অভাব হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি ভালো ইন্টার্নশিপ বা স্বেচ্ছাসেবী কাজের অভিজ্ঞতা অনেক সময় একাডেমিক ফলাফলের চেয়েও বেশি গুরুত্ব বহন করে।

ভুল স্বপ্ন: ক্যারিয়ার গাইডেন্সের অভাব

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি অর্জনে সাহায্য করে, কিন্তু সঠিক ক্যারিয়ার পথ বেছে নিতে সাহায্য করে না। অনেক শিক্ষার্থী জানেনই না যে তাঁরা কোন ক্ষেত্রে কাজ করতে চান বা তাঁদের জন্য কোন পেশাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। ফলে তাঁরা সবাই একই ধরনের চাকরির জন্য আবেদন করেন, যা প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়ে দেয়।

ক্যারিয়ার গাইডেন্সের অভাবে অনেকেই শুধু 'একটি চাকরি' পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না। তারা জানে না কোন সেক্টরের চাহিদা বাড়ছে, কোন দক্ষতাগুলো এখন শেখা জরুরি, অথবা কিভাবে একটি ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং তৈরি করতে হয়।

পথের দিশা: নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করবেন?

চাকরির বাজার যতই কঠিন হোক, সঠিক প্রস্তুতি থাকলে সফল হওয়া অসম্ভব নয়।

১. নিজেকে চিনুন: আপনার আগ্রহ এবং কোন বিষয়ে আপনি পারদর্শী, তা খুঁজে বের করুন। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন—আপনি কোন সেক্টরে কাজ করতে চান?

২. দক্ষতা অর্জন করুন: অনলাইন কোর্স প্ল্যাটফর্ম (যেমন Coursera, Udemy, বা LinkedIn Learning) ব্যবহার করে আপনার পছন্দের ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো শিখুন। এগুলো আপনার সিভির ওজন বাড়াবে।

৩. অভিজ্ঞতা তৈরি করুন: শিক্ষাজীবনে যতটা সম্ভব ইন্টার্নশিপ, পার্ট-টাইম জব বা স্বেচ্ছাসেবী কাজে অংশ নিন। এই অভিজ্ঞতা আপনাকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে।

৪. নিজেকে ব্র্যান্ড করুন: একটি প্রফেশনাল LinkedIn প্রোফাইল তৈরি করুন এবং আপনার দক্ষতা ও আগ্রহের ক্ষেত্রগুলো সেখানে তুলে ধরুন। বিভিন্ন সেমিনার ও ক্যারিয়ার ফেয়ারে অংশ নিয়ে পেশাদার নেটওয়ার্ক তৈরি করুন।

চাকরির প্রতিযোগিতা থাকবেই, কিন্তু যারা শুধু ডিগ্রি নির্ভর না হয়ে নিজেকে সবদিক থেকে প্রস্তুত করবে, তারাই এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকবে। শেষ পর্যন্ত, ডিগ্রি শুধু একটি প্রবেশপত্র, আর আপনার দক্ষতা ও শেখার মানসিকতাই হলো সফলতার আসল চাবিকাঠি। আপনি যে বিষয়ে চাকরি করতে চান সেই বিষয়ে  ইন্টার্নশিপ বা ভলান্টারি কাজ করুন , এখানে আপনার টাকার থেকে দক্ষতা প্রয়োজন বেশি। দক্ষতা হলে আপনি  সেই চাকরিতে দ্রুত বাস্তব বিষয় গুলো তুলে ধরতে পারবেন এবং অন্যদের থেকে আপনার কোয়ালেটি ভাল এইটা প্রমাণ করতে পারবেন।