৩৭তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রহমত আলী। কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন? কী ছিল তাঁর কৌশল। লিখেছেন স্বপ্ন নিয়েতে


ছোটবেলা থেকে ক্যাডার সার্ভিসের প্রতি বাবার আগ্রহ ও উৎসাহের কথা শুনে বড় হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখে যখন এ সম্পর্কে আরও জানলাম, তখন আমার ভেতরেও বিসিএস, বিশেষ করে পররাষ্ট্র ক্যাডার হওয়ার প্রতি একধরনের আকর্ষণ কাজ করতে শুরু করল। যদিও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্র হিসেবে তখনো এই আত্মবিশ্বাস পাইনি যে আমার দ্বারা বিসিএস সম্ভব। কারণ সবাই বলত, একাডেমিক রেজাল্ট ভালো করলেই বিসিএসে ভালো করা যায় না।

গাজীপুর কাওরাইদ কেএন উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক আর ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক—দুটো পরীক্ষাতেই জিপিএ ৫ পেয়েছি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে মাইক্রোবায়োলজিতে আমার সিজিপিএ ছিল সর্বোচ্চ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলের জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পেয়েছি, ডিন’স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। তবু আর সবার মতো বিসিএস নিয়ে দ্বিধা কাজ করেছে আমার মধ্যেও। ভেবেছি, আমি কি পারব?

স্বপ্ন হলো সত্যি
৩৭তম বিসিএসের বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর বন্ধুদের দেখাদেখি আমিও আবেদন করলাম। উদ্দেশ্য ছিল, প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়ে আদতে নিজেকে পরীক্ষা করা। স্নাতকোত্তরের থিসিস যখন জমা দিয়ে দিলাম, প্রিলির আর দুই মাস বাকি। ভাবলাম, সময় নষ্ট না করে জোর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি।

প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়াটাই বোধ হয় আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। নইলে হয়তো ধরেই নিতাম, বিসিএস আমাকে দিয়ে হবে না। যাহোক, আত্মবিশ্বাস পুঁজি করে নতুন উৎসাহে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। পরীক্ষা ভালোই হলো। ভাইবা ভালো হওয়ার পর, ভালো ক্যাডার পাব সেই প্রত্যাশা জন্মেছিল। কিন্তু পররাষ্ট্রে প্রথম হয়ে যাব, সত্যি বলতে এতটাও আশা করিনি! এটাই আমার প্রথম বিসিএস, তার ওপর কোথাও কোচিং করিনি। অন্যদের সঙ্গে আমার প্রস্তুতি ও সামর্থ্যের পার্থক্য কতটুকু, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। তবু আল্লাহর রহমতে প্রথম হয়েছি।

এখন মা-বাবা-স্বজনেরা খুব খুশি। আমার ওপর সবার আস্থা দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি। সবাই নাকি আগেই জানত, আমার পররাষ্ট্র ক্যাডারে হবে। বন্ধুবান্ধবেরা অভিনন্দন জানাচ্ছে, অনেকে আবার ‘ট্রিট’ চাইছে। এ এক মধুর যন্ত্রণা!

কী ছিল কৌশল?
আমার প্রস্তুতির প্রধান কৌশলই ছিল পরিকল্পনামাফিক গুছিয়ে পড়াশোনা। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করতাম। তাই বিসিএসের ফল নির্ধারণী বিষয়—বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজিটা চর্চার মধ্যেই ছিল। প্রিলির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বাকি যে বিষয়গুলোতে দুর্বল ছিলাম, সেগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। তা ছাড়া প্রিলিতে চাইলেই পুরো ২০০ নম্বরের উত্তর সঠিকভাবে করে আসা সম্ভব নয়, এই বাস্তবতা মাথায় রেখে এমনভাবে পরিকল্পনা সাজিয়েছি, যেন কম পড়েও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ উত্তর করে আসতে পারি।

লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় যেসব বিষয় ভালোভাবে লিখলে বেশি নম্বর আসে, সেগুলো আগে রপ্ত করেছিলাম। যেসব টপিক পড়ে গেলেও কমন পড়ে না কিংবা ভালোভাবে লিখলেও গড়পড়তা নম্বরই পাওয়া যায়, সেগুলোর পেছনে সময় কম দিয়েছি। গত এক বছরের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের ফিচার ও উল্লেখযোগ্য সম্পাদকীয়গুলো কেটে একত্র করে নোট তৈরি করেছিলাম, যা সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। আর পরীক্ষায় প্রতিটি নম্বরের জন্য কত মিনিট বরাদ্দ করতে হবে, সে কথা মাথায় রেখে উত্তর দিয়েছি।

সবার আগে নিজের পড়া
আমি বিশ্বাস করি, বিসিএসের প্রস্তুতি নিলেও নিজের পড়ার বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। পড়া শেষ করার পর যদি সময় পাওয়া যায়, তাহলে বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে একাডেমিক পড়ালেখার পরেও কিন্তু অনেক সময় পড়ে থাকে, তখন চাইলেই নিজের দুর্বলতাগুলোতে ঝালাই করে নেওয়া যায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিসিএসের প্রস্তুতি মানে তো কেবল বিসিএসের বই পড়া নয়। চাইলেই কিন্তু ইংরেজি কিংবা গণিতে নিজের দক্ষতা বাড়ানো যায়। পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়ে নিজের বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটানো যায়। বিসিএসের অজুহাত দেখিয়ে একাডেমিক পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করলেই যে বিসিএসে হয়ে যাবে, এমনটা ভাবা বোকামি। তখন কিন্তু এ কূলও যাবে, ও কূলও যাবে। কারণ, দিন শেষে আপনার সনদ আর তাতে লেখা সিজিপিএই আপনার যোগ্যতার পরিচয় দেবে।

নিজ বিভাগের পড়ালেখায় ভালো ছিলাম বলেই কিন্তু আমি সাহস পেয়েছি। আমার কাছে বিকল্প পরিকল্পনা ছিল। বিসিএসে না হলে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করতাম। এখন পর্যন্ত আমার তিনটি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাই উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে বৃত্তির আবেদন করার কথাও মাথায় ছিল।

আমি মনে করি, যাঁরা বিসিএসের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন, তাঁদের সবারই উচিত বিকল্প পরিকল্পনা হাতে রাখা। এমনও তো হতে পারে, আপনার জন্য আরও ভালো কোনো সুযোগ অপেক্ষা করছে! আপনি আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করছেন কি না, সেটাই বড় কথা।

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য ৫ পরামর্শ
১. নিজের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে জেনে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাতে হবে এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। যা পড়ছি, সেটা কোনো রকমে না পড়ে গভীরে গিয়ে বুঝে বুঝে পড়তে হবে। প্রয়োজনে যা পড়লাম, তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আর অবশ্যই ইংরেজিতে লেখার এবং কথা বলার দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

২. যেকোনো পরীক্ষার ক্ষেত্রেই সিলেবাস এবং আগের বছরের প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। বিসিএসও ব্যতিক্রম নয়। প্রস্তুতি গ্রহণের আগে অবশ্যই সিলেবাসের কোন কোন বিষয় থেকে এর আগে প্রশ্ন এসেছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এতে সহজেই বুঝতে পারবেন, কোন কোন বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া জরুরি। খেয়াল করে দেখবেন, কিছু বিষয় থেকে নিয়মিতই প্রশ্ন আসে। আবার কিছু বিষয় থেকে খুব বেশি প্রশ্ন আসে না। যেসব বিষয় থেকে প্রশ্ন কম হয়, সেগুলোর পেছনে বেশি সময় নষ্ট করবেন না।

৩. বিসিএসের সাফল্য অনেকটা নির্ভর করে বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণ, ইংরেজি ব্যাকরণ ও অনুবাদ, গণিত ও মানসিক দক্ষতা, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ এবং চলমান প্রধান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের পরিষ্কার ধারণার ওপর। এগুলোর কোনোটাতে দুর্বলতা থাকলে অবশ্যই তা দূর করতে হবে।

৪. বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় যে বিষয়টি আপনাকে এগিয়ে দেবে সেটা হলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের জ্ঞান। সেগুলো একত্র করে নোট রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং কোনো তথ্য পরিবর্তিত হলে সেটাকে হালনাগাদ করতে হবে।

৫. বিসিএসের প্রস্তুতি মানে সারা দিন বিসিএসের বইয়ে মুখ গুঁজে রাখা নয়। নিয়মিত খবর দেখা, পত্রিকা পড়া, খেলা দেখা, গান শোনা, কবিতা পড়া, গল্প-উপন্যাস পড়া, আড্ডা দেওয়া, ভালো ইংরেজি ও বাংলা সিনেমা দেখা, দর্শনীয় স্থানে কিংবা নিজের এলাকায় বেড়ানো—এসবও কিন্তু পরোক্ষভাবে একজন ক্যাডার হিসেবে আপনাকে গড়ে তুলবে। আপনি আপনার এলাকা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন কি না, দেশের উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলো দেখেছেন কি না, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিংবা বিখ্যাত বই-নাটক-সিনেমা সম্পর্কে অবগত আছেন কি না—ভাইবাতে কিন্তু এসবও দেখা হয়।