করোনার জন্য নির্ধারিত রাজধানীর নয়টি সরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) এখন ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা। গতকাল শুক্রবার এসব হাসপাতালের প্রায় ৯৪ শতাংশ আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। করোনা শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করায় সাধারণ শয্যাতেও রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। সাধারণ শয্যার ৭৭ শতাংশে রোগী ভর্তি ছিল।
রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও সাধারণ শয্যা এবং আইসিইউতেই করোনা রোগীর চাপ বেড়েছে। রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটকে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এর বাইরে ঢাকার আরও পাঁচটি হাসপাতালকে করোনা রোগী ভর্তি করানোর জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গত বুধবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, যে হারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ‘আলটিমেটলি কুলাবে না’।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীতে করোনার জন্য নির্ধারিত ৯টি হাসপাতালের ১০৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে গতকাল ১০১টি আইসিইউতেই রোগী ভর্তি ছিল। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোনো আইসিইউ শয্যা গতকাল ফাঁকা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল এবং সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ১টি করে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। আর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি আইসিইউ শয্যার ১১টিতে রোগী ভর্তি ছিল।
শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এর জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। তিন সপ্তাহ আগেও হাসপাতালের আইসিইউ পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। তখন এসব হাসপাতালের আইসিইউ শয্যার ৩৫ শতাংশই ফাঁকা ছিল। ১০ মার্চ থেকে দেশে দৈনিক ১ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৪ দিন ধরে দৈনিক সাড়ে ৩ হাজারে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
রাজধানীর ৯টি বেসরকারি হাসপাতালে করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যা এবং ভর্তি রোগীর তথ্যও প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে দেখা যায়, ইমপালস হাসপাতালের ৩৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ৩৪টিতেই গতকাল রোগী ভর্তি ছিল। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ১৮৩টি আইসিইউর মধ্যে ১৩০টিতে রোগী ভর্তি ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২ হাজার ৪০১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৫১টি (৭৭ শতাংশ) শয্যায় গতকাল রোগী ভর্তি ছিল। অথচ ফেব্রুয়ারিতে এসব হাসপাতালের ৭০ শতাংশ শয্যাই ফাঁকা ছিল।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২৭৫টি। গতকাল এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিল ৪২০ জন। অর্থাৎ ধারণক্ষমতার চেয়েও ১৪৫ জন রোগী বেশি ভর্তি ছিল এই হাসপাতালে।
রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় ২২ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় সরকারি পাঁচটি হাসপাতালকে পুনরায় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হাসপাতালগুলো হচ্ছে মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডিএনসিসি করোনা আইসোলেশন সেন্টার এবং সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল।
প্রসঙ্গত, গত বছর করোনায় আক্রান্ত রোগী বাড়তে থাকায় এসব হাসপাতালকে করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে রোগীর সংখ্যা কমে আসায় এসব হাসপাতালে অন্য রোগীদের সেবা চালু করা হয়।
এদিকে পৃথক আদেশে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা চালু করতেও নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের কথা জানায় সরকার। গত জুন থেকে আগস্ট—এই তিন মাস করোনার সংক্রমণ ছিল তীব্র। মাঝে নভেম্বর-ডিসেম্বরে কিছুটা বাড়লেও বাকি সময় সংক্রমণ নিম্নমুখী ছিল। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত জুন-জুলাইয়ের আলামত দেখা যাচ্ছে।
১০ মার্চ থেকে দৈনিক এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্ত, শনাক্তের হার ও মৃত্যু প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষার চাপও বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত) করোনায় সংক্রমিত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৭৩৭ জন, যা ২৬৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। এর চেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছিল গত বছরের ২ জুলাই, সেদিন ৪ হাজার ১৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
এ পর্যন্ত দেশে মোট ৫ লাখ ৮৮ হাজার ১৩২ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৮ হাজার ৮৩০ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯৫১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৫৭ জন।
তিন মাসের বেশি সময় পরে গত ১৮ মার্চ দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার আবার ১০ শতাংশ ছাড়ায়। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২৭ হাজার ২৯৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সূত্রঃ প্রথম আলো