পিএসসির অধীনে নন-ক্যাডারে নিয়োগ পরীক্ষা

সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ভাইভা প্রস্তুতি

প্রথমবারের মতো পিএসসির অধীনে মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় অনেকেরই এর ভাইভা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। পিএসসিতে বহুবার ক্যাডার ও নন-ক্যাডার ভাইভায় মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে ভাইভা প্রস্তুতি, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণবিধি নিয়ে লিখেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা রবিউল আলম লুইপা (প্রভাষক, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ)

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদে লিখিত (এমসিকিউ পদ্ধতিতে) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরাই শুধু মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। সাত হাজার ১৬১ জন ভাইভাপ্রার্থীর মধ্যে দুই হাজার ৭৯২ প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। পর্যায়ক্রমে অন্য প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার তারিখও ঘোষণা করা হবে।

পিএসসির অধীনে সব ক্যাডার ও নন-ক্যাডার ভাইভার প্রস্তুতির ধরন কাছাকাছি হলেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদের ভাইভায় সাধারণ বিষয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও বিষয়ভিত্তিক (প্রার্থীর শিক্ষকতার বিষয়) জ্ঞান সম্পর্কে অনেক প্রশ্নই করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভাইভা প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে দুই ভাগে—

১. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পদসংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান

২. ব্যক্তিগত তথ্য ও সাধারণ জ্ঞান

১. বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : বাংলাদেশের তিন স্তরবিশিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও মাধ্যম, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সময়ে প্রণীত শিক্ষানীতি, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আদ্যোপান্ত, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর কার্যাবলি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আধীন দপ্তর [যেমন—মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ইত্যাদি], শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব ও মাউশির মহাপরিচালকের নাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (যেমন—জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি), উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক ইনস্টিটিউট (এইচএসটিটিআই), মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের অফিস (যেমন—উপপরিচালকের কার্যালয়, জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস), শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত অতীত ও বর্তমান পদক্ষেপ, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পরিমাণ, বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ইত্যাদি তথ্য নোট করে পড়ে নেবেন। এ ছাড়া ‘আপনি কেন শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান?’ বা ‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো অসংগতি আছে কি?’ বা ‘শিক্ষা খাতের উন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন?’—এ রকম টেকনিক্যাল প্রশ্ন করা হতে পারে। টেকনিক্যাল প্রশ্ন দিয়ে প্রার্থীর দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে ধারণা নেওয়া হয়। তাই এ ধরনের প্রশেনর উত্তরে ইতিবাচক ও কৌশলী হতে হবে।

পদসংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান : বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত বিষয়ভিত্তিক ১২টি ক্যাটাগরির সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অবশ্যই মৌলিক ধারণা থাকতে হবে। বিসিএস ও জেনারেল কোরের নন-ক্যাডারের ভাইভা বোর্ডে সাবজেক্ট স্পেশালিস্ট না থাকলেও ‘সহকারী শিক্ষক’ ভাইভায় বিষয়ভিত্তিক স্পেশালিস্ট থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনার পঠিত অনার্স ও মাস্টার্সের সিলেবাস থেকে কোর্সের নাম, সাবজেক্টের মৌলিক জ্ঞান (যেমন—সাবজেক্টের জনকের নাম), আপনার পঠিত বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ের বিষয়বস্তু থেকে প্রশ্ন হতে পারে। যেহেতু আপনি একজন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন, ভাইভা বোর্ডে পাঠদানের বিষয় সংশ্লিষ্ট দুই মিনিটের লেকচার দেওয়ার জন্যও বলা হতে পারে।

২. ব্যক্তিগত তথ্য : নিজের নামের অর্থ, নামের সঙ্গে মিল থাকা কোনো স্বনামধন্য ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য, আপনার জন্মস্থান, জন্মতারিখ বা সালে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্ম কিংবা ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য (প্রতিষ্ঠাকাল, প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নাম, বিখ্যাত প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইত্যাদি) ও নিজ জেলা সম্পর্কে (প্রতিষ্ঠা সাল, নামকরণ, বিখ্যাত ব্যক্তি, দর্শনীয় স্থান, জেলা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি) বিস্তারিত জেনে যেতে হবে। সাধারণত সব ভাইভা শুরু হয় Introduce yourself প্রশ্ন দিয়ে। এই প্রশ্নের মাধ্যমে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য যেমন জানা হয়, পাশাপাশি আপনার বাংলা ও ইংরেজি বাচনভঙ্গির ধরনও যাচাই করা হয়।

সাধারণ জ্ঞান : যেকোনো মৌখিক পরীক্ষায় চলমান ঘটনা, দেশের ইতিহাস, সংবিধান ও বিভিন্ন ধরনের সাধারণ জ্ঞান যাচাই করা হয়। মৌখিক পরীক্ষার এই অংশের প্রস্তুতি এক দিনে সম্ভব নয়; সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞান, স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক এবং চাকরির প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি এখানে খুব কাজে দেয়।

♦ Introduce yourself, Introduce your district, Your todays journey from home to BPSC, Your last night activities ইত্যাদি প্রশ্ন করার মাধ্যমে প্রার্থীর ইংরেজি স্কিল যাচাই করা হয়। এ ছাড়া যেকোনো বাক্যের ট্রান্সলেশন জিজ্ঞেস করা হতে পারে। তাই বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে প্রশ্নোত্তরের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি রাখা ভালো।

♦ ভাইভার দিনের ইংরেজি, বাংলা ও আরবি তারিখ আগে থেকে জেনে রাখবেন। ভাইভার দিন কোনো বিশেষ দিবস থাকলে, তার পটভূমি ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কেও ধারণা রাখবেন। বের হওয়ার আগে সকালে সংবাদপত্রের ওপর একটু চোখ বুলিয়ে নেবেন। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

♦ বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন, সংগ্রাম ও অবদান, বাংলাদেশের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো সম্পর্কে আপনার স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণ ধারণা থাকতে হবে।

♦ বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও অন্যান্য তথ্য, জেলা-উপজেলা ও নদ-নদী, প্রশাসনিক কাঠামো, স্থানীয় সরকার, বৈশ্বিক সংকট, রোহিঙ্গা সমস্যা, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, করোনা মহামারি ইত্যাদি সম্পর্কে ভাইভায় প্রশ্ন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

♦ বর্তমান সরকারের সফলতা ও অর্জন, মুজিববর্ষ, ভিশন-২০২১, ভিশন-২০৪১, মেগাপ্রজেক্ট, এসডিজি ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট জানাশোনা থাকতে হবে।

♦ ভাইভার প্রস্তুতির জন্য বাজারের প্রচলিত ভাইভা গাইড, উইকিপিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট, ফেসবুকভিত্তিক চাকরির প্রস্তুতিমূলক গ্রুপগুলো আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে। ভাইভায় পাস নম্বর ৪০ শতাংশ (মোট ৫০ নম্বর) হলেও, এমসিকিউ পদ্ধতির লিখিত পরীক্ষায় (২০০ নম্বর) যাঁরা একটু পিছিয়ে আছেন, একটু পড়াশোনা ও সচেতনভাবে ভাইভা দিয়ে ৫০ নম্বর নিশ্চিত করতে পারলে সার্বিকভাবে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারবেন।

দ্রষ্টব্য : ১২ ক্যাটাগরিতে এক হাজার ৩৭৮ জনকে নিয়োগের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ২০১৯ সালে দুই লাখ ৩৫ হাজার ২৯৩ প্রার্থী এমসিকিউ পদ্ধতির লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। এই পরীক্ষায় সাত হাজার ১৬১ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন।

ভাইভার পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণবিধি
♦ ছেলেরা হালকা রঙের (সাদা হলে সবচেয়ে ভালো) ফুলহাতা শার্ট এবং গাঢ় রঙের (কালো হলে সবচেয়ে ভালো) প্যান্ট, কালো রঙের অক্সফোর্ড ফিতা শু পরতে পারেন। টাই ও ঘড়ি পরার বাধ্যবাধকতা নেই, তবে টাই পরলে ম্যাচ করে (সাদা শার্টের সঙ্গে মেরুন বা নেভি ব্লু) পরবেন এবং ঘড়ি পরলে এটা আপনাকে ফরমাল লুক দেবে।

♦ মেয়েরা হালকা ও মিষ্টি রঙের সুতি শাড়ি পরতে পারেন। এর সঙ্গে মিলিয়ে কলার থ্রি-কোয়ার্টার হাতা ব্লাউজ এবং শব্দহীন স্লিপার স্যান্ডেল পরলে ভালো হয়। প্রসাধনী ও অলংকার পরলে একেবারে হালকা ও সাধারণভাবে পরবেন। অফিশিয়াল লুকের জন্য হাতে হাতঘড়ি পরা যেতে পারে।

♦ ভাইভা বোর্ডে আপনার সঠিক প্রশ্নোত্তরের চেয়ে উত্তরের স্টাইল ও বিনয়টা দেখা হবে। তাই সব সময় বিনয়ী আচরণ করবেন হাসিমুখে। বাংলা কিংবা ইংরেজি—যে ভাষায় প্রশ্ন করা হবে সেই ভাষায়ই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কোনো উত্তর না জানা থাকলে বিনয়ের সঙ্গে বলবেন, ‘স্যরি স্যার, উত্তর জানা নেই।’ আপনার একটি প্রশ্নোত্তর থেকেই পরবর্তী প্রশ্ন হতে পারে। তাই প্রশ্নোত্তরের সময় কৌশলী হলে ভাইভা বোর্ডের প্রশ্নগুলো আপনার জানার পরিধির মধ্যেই থাকতে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ‘সহকারী শিক্ষক’ নিয়োগ করা হয়। এটি বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড হলেও চাকরির সময়কাল আট বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার গেজেটেড পদমর্যাদার হবে (প্রজ্ঞাপন জারি হলেও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি)। চাকরির ফিডার পূর্তি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সহকারী শিক্ষক থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার, প্রধান শিক্ষক, জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপপরিচালক (মাধ্যমিক) পর্যন্ত পদোন্নতি পাওয়া সম্ভব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা অফিস ছাড়াও সরকার ও মন্ত্রণালয় একজন সহকারী শিক্ষককে শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে যেকোনো দপ্তরে পদায়ন করতে পারে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পদায়নকালে ক্লাসে পাঠদান, বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা ও অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটিতে কাজসহ একজন সহকারী শিক্ষককে নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।

মো. মোকছেদুর রহমান
জেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত), শেরপুর

সুত্রঃ কালের কন্ঠ