পাবনা চাটমোহরের তরুণ শাহীন আহমেদ শিক্ষাজীবন শেষ করে এখন বেকার। একটা সরকারি চাকরির জন্য ঘুরছেন এক দুয়ার থেকে অন্য দুয়ারে। প্রতিদিন সকালে স্টলে গিয়ে দৈনিক পত্রিকার পাতায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খোঁজেন। কিন্তু এখন আর তেমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থাকে না পত্রিকাগুলোয়। তাই অনেক সময় হতাশ হয়েই বাসায় ফেরেন শাহীন আহমেদ। শুধু শাহীন নয়, এভাবে নড়াইলের কবির, রাজশাহীর জয়নাল, বরগুনার সোহেলও প্রতিদিন সকালে পত্রিকার পাতায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খোঁজেন।
জানা গেছে, মার্চে দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সারাদেশ লকডাউন এবং সবকিছু বন্ধের সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়া। এ সময়ে নিয়োগ সংক্রান্ত চলমান প্রক্রিয়াও থেমে যায়। গত ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে সরকারি শর্তসাপেক্ষে অফিস আদালত চালু হওয়ার পরেও শুরু হয়নি নিয়োগ প্রক্রিয়া। তবে গত ৪ আগস্ট থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসা থেকে অফিস করার সুযোগ বাতিল করার পর থেকে কিছু কিছু সরকারি দফতরে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যদিও এ সংখ্যাটি খুবই কম, তারপরেও বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন চাকরিপ্রার্থী তরুণরা। করোনার কারণে থেমে থাকা নিয়োগ প্রক্রিয়ার জট ধীরে ধীরে খুলবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে করোনার প্রভাবে সময়টি খুবই খারাপ সময় পার করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন অভিযোগে অনেক প্রতিষ্ঠানই ইতিমধ্যেই জনবল ছাঁটাই করেছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সরকারি চাকরি তো সোনার হরিণ, তাই অনেকে এর পেছনে ছুটে সর্বস্বান্ত হয়ে ঘরে ফিরেছেন বয়স খুইয়ে। আবার যাদের বয়স আছে, তারা অনেকেই সরকারি চাকরির আশা বাদ দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির খোঁজ করছেন অনবরত। কিন্তু করোনার এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হালহকিকত দেখে চাকরিপ্রার্থী তরুণরা চোখেমুখে দেখছেন অন্ধকার।
জানতে চাইলে চাকরি প্রার্থী পাবনার শাহীন জানিয়েছেন, এখনও কিছুটা বয়স আছে সরকারি চাকরি নেওয়ার ক্ষেত্রে। এজন্যই আশা নিয়েই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খুঁজি। কিছু প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে আবেদন করেছি। করোনার কারণে সেসব পদে এখনও নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি। কবে হবে জানি না।
বরগুনার সোহেল জানিয়েছেন, করোনার অনেক আগেই ব্যাংকে আবেদন করেছি। এখনও কোনও খবর পাচ্ছি না। কবে নাগাদ এসব পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউই। সবাই বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেই প্রক্রিয়া শুরু হবে। আর পরিস্থিতি কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে তা কে জানে?
এদিকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সূত্রে জানা গেছে, করোনার পর আবারও স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে পিএসসি। তবে করোনার সময় অনেক সেক্টরের নিয়োগ পরীক্ষা নিতে পারেনি। বর্তমানেও নিতে পারছে না। কারণ চাকরির পরীক্ষা মানেই জনসমাগম। আর করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জনসমাগম এড়িয়ে চলার কোনও বিকল্প নাই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিএসসি’র চেয়ারম্যান মোহম্মদ সাদেক জানিয়েছেন, করোনা তো সারা বিশ্বকেই থামিয়ে দিয়েছে। আমরা তো আর এর বাইরে নই। আমাদের অনেক কার্যক্রমই থামিয়ে রাখতে হয়েছে। তবে অফিস খোলার পর আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পুরোদমে নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম চলবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনস্থ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে অফিস সহায়ক ৫৫টি পদের বিপরীতে গত মার্চে আবেদনপত্র গ্রহণ করা হলেও নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি করোনার কারণে। এই অধিদফতরে কনস্টেবল পদে ৪৮১টি পদের বিপরীতে আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়েছে করোনার অনেক আগে। এ পদের জন্য নিয়োগ পরীক্ষা বা নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এদিকে একই অধিদফতর ৩ সেপ্টেম্বর ৪৫টি ওয়ারলেস অপারেটর পদে যোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করেছে। অধিদফতর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনার কারণেই এসব পদে নিয়োগ কার্যক্রম আটকে ছিল। এখন সেগুলোর কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে সব পদেরই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) বিভিন্ন পদে নিয়োগ কার্যক্রম করোনার কারণে আটকে আছে বলে জানিয়েছেন পিকেএসএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুদ্দিন আবদুল্লাহ। তিনি জানিয়েছেন, করোনার কারণে এতদিন এ নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানো যায়নি। তবে পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার শর্তে ধীরে ধীরে সংস্থার বিভিন্ন শূন্যপদে জনবল নিয়োগ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন দফতর ও সংস্থায়ও ছোটবড় অনেক পদ খালি রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সামগ্রিকভাবে এসব পদের সংখ্যা কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৮ হাজার। এসব পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া দফতর ও সংস্থা নিজ নিজ সুবিধামতো সময়ে নেয়। সারা বছরই এ কার্যক্রম চলে, তবে এ বছরের চিত্র ভিন্ন।
এদিকে সারাদেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাড়ে ২২ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদে নিয়োগের উদ্দেশ্যে আবেদনপত্র চাওয়া হবে। যাচাই-বাছাই শেষে শিক্ষক নিয়োগে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিবন্ধিত প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ করা হবে। এই শূন্যপদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এরপর মেধাতালিকার ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। নভেম্বরের মধ্যে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন জানিয়েছেন, সাড়ে ২২ হাজার সহকারী শিক্ষকের শূন্যপদের তালিকা পেয়েছি। এসব তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। তালিকা চূড়ান্ত করে নিবন্ধিত প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে গত ২ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাংবাদিকদের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, দীর্ঘদিন শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। এ কারণেই শিক্ষকের এতো পদ শূন্য রয়ে গেছে। শিক্ষক নিয়োগের সেই উদ্যোগ নিয়েছি। কিছুদিনের মধ্যেই এ কার্যক্রম শুরু হবে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ‘সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর’, ‘ক্যাটালগার’ ‘হিসাবরক্ষক’ ও ‘অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক’ এ চার পদে লিখিত ও ব্যবহারিকে উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা আগামী ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকার তোপখানা রোডস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট ভবনে এ পরীক্ষা হবে। ২০ আগস্ট এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, করোনার কারণেই অনেক দিন এ নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখন ধীরে ধীরে এগুলো চলবে। সংশ্লিষ্টরাই এ কাজটি করবে। সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন