শূন্য পদের সংখ্যা হাতে গোনা, সেই তুলনায় চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা ঢের বেশি। একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হলে প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় পদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে অনেক গুণ বেশি। আর এই সুযোগ নেন চাকরিদাতারা। নিয়োগকর্তাদের কাছে বিষয়টা এ রকম—চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে তাঁরা যাচ্ছেতাই করতেই পারেন; ব্যাংক ড্রাফট-পে-অর্ডার তো যত্সামান্যই! সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব চাকরির আবেদনেই পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট বাবদ গুনতে হয় শত শত টাকা। চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই, ইন্টারভিউ কার্ড কিংবা লিখিত পরীক্ষার প্রবেশপত্র আসবে কি না, তারও গ্যারান্টি নেই; অথচ তার আগেই গুনতে হয় আবেদন ফি! আর এ টাকা নেওয়া হয় বেকারদের কাছ থেকে, যাঁদের বেশির ভাগেরই আয়ের কোনো পথ নেই।
আবেদন ফি নেওয়া কতটা যৌক্তিক? কারণ হিসেবে নিয়োগকর্তারা হয়তো নিয়োগ-সংক্রান্ত খরচ মেটানোর কথা বলবেন। নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া, উত্তরপত্র মূল্যায়ন প্রভৃতি কাজে খরচ হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এ খরচ কেন একজন বেকারের ঘাড়ে এসে পড়বে? কোনো প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজনেই যেখানে নতুন কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়, নিয়োগ-প্রক্রিয়ার সব ব্যয়ও বহন করা উচিত তাদের। নিয়োগ-সংক্রান্ত ব্যয় মেটানোর জন্য বাজেটও থাকা উচিত একটি প্রতিষ্ঠানের। প্রতিষ্ঠান যদি পুরোটা বহন না–ও করে, সে ক্ষেত্রে আবেদন ফি এমন হওয়া উচিত, যাতে নিয়োগ-সংক্রান্ত ব্যয়ের অর্ধেক বহন করবে প্রতিষ্ঠান, অর্ধেক চাকরিপ্রার্থীরা। তাও না হলে ফি এমন সহনীয় পর্যায়ে রাখা উচিত, যাতে নিয়োগ-সংক্রান্ত ব্যয় মিটে যায়।
বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা, চাকরির আবেদন ফি নিয়োগ-সংক্রান্ত ব্যয়ের তুলনায় ঢের বেশি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন ফির নামে ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার সংগ্রহ করে রীতিমতো ব্যবসা করে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। একবারে চাহিদামাফিক জনবল নিয়োগ না দিয়ে ইচ্ছা করেই বারবার বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান, এতে একই প্রার্থী একই প্রতিষ্ঠানে বারবার ব্যাংক ড্রাফট করছেন। এমনও হচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে, প্রার্থীদের বাছাইয়ের জন্য ডাকছে না। যেসব চাকরিতে আবেদন ফি ৩০০ টাকা, সেখানে আবেদন, আবেদনপত্র পাঠানোসহ আনুষঙ্গিক কাজে কম করে হলেও ৫০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। আর ৫০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট হলে সব মিলিয়ে লেগে যায় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
আগে বিসিএস পরীক্ষার ফি ছিল ৫০০ টাকা। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটা বাদে সাধারণদের আবেদন ফি বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭০০ টাকা। যেসব শিক্ষার্থীর নিজস্ব কম্পিউটার ও ইন্টারনেট-সুবিধা নেই, তাঁদের আবেদন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে খরচ হয় কম করে হলেও ৮০০ টাকা। অনেক আবেদনে গুনতে হয় আরও বেশি ফি। একজন বেকার এত টাকা কোত্থেকে দেবেন?
শুধু ফি দিয়ে কাজ সারলে বাঁচা যেত; আবেদনের পর বাছাই পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভার জন্য প্রয়োজনীয় বই কেনা, প্রস্তুতি, পরীক্ষাস্থলে যাওয়া-আসাতেও খরচ হয় প্রচুর। টাকা না থাকায় অধিকাংশ সরকারি চাকরির আবেদনই করতে পারেন না অনেকেই।
এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অধিকাংশ মেধাবী তরুণ-তরুণী টিউশনি কিংবা বাসা থেকে পাঠানো টাকার ওপর নির্ভর করে চাকরিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সীমিত টাকায় চলতে গিয়ে যখন প্রতি মাসেই চাকরির আবেদনের জন্য ফি গুনতে হয়, তখন তাঁদের পড়তে হয় বিপাকে। প্রতি মাসে যদি কেউ তিনটি চাকরির আবেদন করেন, তবে বাড়তি গুনতে হবে কমপক্ষে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। এই টাকা অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থীর কাছেই ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’।
চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে টাকা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাঁর টাকা আছে, তিনি সব প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারছেন। যাঁর নেই, তিনি পারছেন না। চাকরির আবেদন ফি জোটাতে টাকা ধারের জন্যও অনেককে দ্বারস্থ হতে হয় অন্যের। যেসব বিজ্ঞপ্তিতে পদ বেশি থাকে, তাতেই আবেদন করেন অনেকে। লোক কম নেওয়া হলে জেনেশুনে আবেদন ফি জলে ফেলতে নারাজ তাঁরা। এভাবেই অনেক চাকরিতে আবেদন করা হয়ে ওঠে না অনেকেরই, কেবল পকেটে প্রয়োজনীয় টাকা না থাকায়।
৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করেন ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন শিক্ষার্থী। ৩৬তম বিসিএসেও আবেদন ২ লাখ ছাড়িয়েছে। সাধারণ প্রার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ধরা হলেও টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ কোটি। একটি নিয়োগকার্য সম্পন্ন করতে এত টাকা লাগার কথা নয়। আর বিসিএসের বাছাইপর্ব থেকেই বাদ পড়েন সবচেয়ে বেশি প্রার্থী। তাঁদেরও কেন একই পরিমাণ টাকা গুনতে হবে—এ প্রশ্নও রয়ে যায়।
উন্নত বিশ্বে বেকারদের কর্মসংস্থান হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকার তাঁদের ভাতা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে ঘটছে উল্টোটা। চাকরির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার নামে চলে চাকরিপ্রার্থীর টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা। চাকরির আবেদনের সঙ্গে ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার ও পোস্টাল অর্ডারের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার পদ্ধতি বাতিল করা উচিত। এভাবে বেকারদের শোষণ করা রীতিমতো অনৈতিক। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত না হওয়ায় হয়তো বেকারদের ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তাঁদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ব্যবসা করা অমানবিক। চাকরি হোক আর না হোক, অন্তত সবাইকে বিনা ফিতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। আর আবেদন ফি যদি রাখতেই হয়, তবে তা যেন সবার গা-সহা হয়। এখন চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি, তাই ৩০০, ৫০০, ৭০০ বা তারও বেশি না নিয়ে ১০০ টাকা নেওয়া যেতে পারে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং বিধি ও নীতি শাখা থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এখন থেকে রাষ্ট্রায়ত্তসহ সব ব্যাংকে চাকরির আবেদন করতে কোনো পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট লাগবে না। এর ফলে কোনো ধরনের ফি ছাড়াই ব্যাংকের যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন চাকরিপ্রার্থীরা। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, চাকরির আবেদনের সময় পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক ব্যয় ও কষ্টসাধ্য বিষয়। বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চাকরিপ্রার্থীদের জন্য এটি সুসংবাদই বটে। কিছু বিদেশি সংস্থার আবেদনেও কোনো ফি গুনতে হয় না। এর আগে সরকারি চাকরিতে আবেদন ফি তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। যদিও তা এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
একজন শিক্ষিত বেকার যখন বেকারত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন, রাষ্ট্রের উচিত তাঁর জন্য এগিয়ে আসা। প্রকৃত অর্থে সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে এটা। চাকরিপ্রার্থী যেখানে দীর্ঘ ১৭ বা ১৮ বছরের পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি খুঁজছেন, পরিবার যখন তাঁর দিকে তাকিয়ে এবং তাঁর দিনগুলো কষ্টে অতিক্রম করতে হয়; সেখানে চাকরির আবেদনের জন্যই যদি তাঁকে বড় অঙ্কের টাকা গুনতে হয়, সেটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ নয়কি?
মোহসিনা হোসাইন: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্রঃ প্রথম আলো