বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

স্বামীর স্থায়ী ঠিকানাই হবে স্ত্রীর ঠিকানা

  ৩৩

১৯২৫ সালের দ্য ইন্ডিয়ান সাকসেশন অ্যাক্টের ১৬ নম্বরে বলা হয়েছে, বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে স্বামীর বাড়ি ওই নারী বা স্ত্রীর বাসস্থান হিসেবে বিবেচিত হবে। এর ব্যতিক্রম হতে পারে। যেমন যথাযথ আদালতের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে অথবা কারাদণ্ডের লক্ষ্যে স্বামী যদি স্থানান্তরের জন্য থাকেন। সরকার এ আইনটি বহাল রেখেছে। আর ৯৪ বছর পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিধানই বহাল আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক (জেনারেল) পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ১৪ নম্বরে বলা হয়েছে, ‘বিবাহিত মহিলা প্রার্থীদের ক্ষেত্রে স্বামীর স্থায়ী ঠিকানাকে প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করতে হবে।’

চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে এ ধরনের বিধান যুক্ত এবং তা বাধ্যতামূলক করায় এ পদে আবেদন করতে চাইছেন—এ ধরনের একাধিক প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে বিজ্ঞপ্তি থেকে এ ধরনের বিধানটি বাদ দেয়, সে আহ্বানও জানিয়েছেন তাঁরা।

নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ২০১৯ সালেও চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে এই ধরনের বিধান থাকার মানে হচ্ছে নারীকে আবার পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া। নারীকে স্বামীর ঠিকানা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্ট–১ প্রধান কার্যালয় থেকে সহকারী পরিচালক পদের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রার্থীদের এ পদে আবেদন করতে হবে।

এ পদে আবেদন করতে চাইছেন—এমন এক প্রার্থী বললেন, ‘আমি বিবাহিত। কিন্তু চাকরির আবেদনপত্রে স্বামীর ঠিকানা দিতে চাই না। আমার স্থায়ী ঠিকানা পাল্টাতে হবে বলে এখন পর্যন্ত আবেদন করিনি। আমি আমার বাবার ঠিকানা দিয়েই আবেদন করতে চাই।’

আরেক প্রার্থী বলেছেন, এ ধরনের নির্দেশ বা আদেশের আইনি ভিত্তি নেই। বিসিএস বা অন্য কোনো নিয়োগবিধিতেও আবশ্যিকভাবে স্বামীর ঠিকানাই দিতে হবে, তা উল্লেখ নেই। স্বামীর সঙ্গে তালাক হলে, সম্পর্ক বিচ্ছেদ বা সম্পর্ক খারাপ হলে নারীরা এ ঠিকানা ব্যবহার করে বিপাকে পড়বেন। আর যে নারীরা এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি, তাঁরাও বিপাকে পড়বেন। প্রার্থী চাকরি পেলে পুলিশ ভেরিফিকেশনে গেলে স্বামীর বাড়ির লোকজন প্রার্থী সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন না। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকলে যে তথ্যটুকুও দেবেন, তা মিথ্যা তথ্যও হতে পারে।

এ ধরনের নিয়মকে নারীর ক্ষমতায়নের পথে নেতিবাচক বা নারীর জন্য অপমানজনক বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, নারীর নিজস্ব পরিচয়ের অন্তরায় এ ধরনের নিয়ম। নারী যদি স্বামীর ঠিকানা ব্যবহার করতে চান, তা নারীর ইচ্ছা। এখানে বাধ্য করা যাবে না।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ব্যাংটির মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বললেন, ‘চাকরির আবেদন করতে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে, বিষয়টি সে রকম নয়। তালাক অথবা কোনো কারণে ওই নারী প্রার্থী পরে যদি স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করতে চান, তাও করতে পারবেন। এতে সমস্যার কিছু নেই। নারী প্রার্থীর চাকরির সঙ্গে কিছু বেনিফিট থাকে, যা স্বামী পান। আবেদন করার সময় কোনো প্রার্থী অবিবাহিত থাকলে চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে করলে সে তথ্যও জানাতে হয়। এ ছাড়া ১৯২৫ সালের দ্য ইন্ডিয়ান সাকসেশন অ্যাক্টেও বলা আছে, বিবাহিত নারীর স্থায়ী ঠিকানা হবে স্বামীর ঠিকানা। সরকার যেহেতু আইনটি বাতিল করেনি, আমরাও সে আইন মেনেই চলছি। তবে এ নিয়ে নারী প্রার্থীদের আপত্তির বিষয়টি নোটিশে নিলাম, ভবিষ্যতে সরকারকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানাব।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বললেন, ১৯২৫ সালের আইনের বিধান বর্তমানে যুগোপযোগী কোনো বিধান হতে পারে না। সরকার আইনে পরিবর্তন না আনলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা আছেন, তাঁরাই তো এ বিষয়ের সুরাহা করতে পারেন।

চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনের ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, স্থায়ী ঠিকানা যদি আগে কোনো সার্টিফিকেট বা অন্যত্র উল্লিখিত স্থায়ী ঠিকানা থেকে ভিন্নতর হয় অথবা নারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে যদি স্বামীর ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে প্রার্থীকে পরিবর্তিত স্থায়ী ঠিকানার সপক্ষে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের মেয়র/ওয়ার্ড কমিশনার/পৌরসভার মেয়র/কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, নোটারি পাবলিক কর্তৃক স্বাক্ষরিত সনদপত্র মৌখিক পরীক্ষায় বোর্ডে জমা দিতে হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বললেন, ‘আমার এই জীবনে আমি এ ধরনের বিধান বা আইন যে আছে তাও শুনিনি বা বিষয়টি আমার কাছে অজানাই ছিল। তার মানে, আইনটি সব সময় ব্যবহার করা হচ্ছে, তেমনও না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে চাকরির ক্ষেত্রে এ বিধান রাখার যুক্তিও অস্পষ্ট। বর্তমানে এ ধরনের বিধান প্রযোজ্যও না। এ বিধান থাকা মানে হলো নারীকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া। তাই বিধানটি সংশোধনযোগ্য।’

শীপা হাফিজা বলেন, ২০১১ সালে সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি করেছে। সে নীতিতে উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নারীর যে আয়, তা তিনি কীভাবে ব্যবহার করবেন বা কাকে দেবেন, তা ওই নারীর নিজস্ব বিষয়। এ ছাড়া নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের জন্য সংশ্লিষ্ট সব আইন, বিধি ও নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার করার কথা বলা হয়েছে।